বিপন্ন শৈশব
-পারমিতা ভট্টাচার্য
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় চলতে গিয়ে আমাদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।আমাদের দেশ ভারতবর্ষ তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় সেখানে আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় নানা রকম সমস্যা শিকড় গেড়েছে অবলীলায়।অপুষ্টি, অশিক্ষা,স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা প্রভৃতি সমস্যার সাথে বেশ বড়সড় আকার নিয়েছে আর একটি সমস্যা,তা হলো’বঞ্চিত শৈশব।’ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের কাছে বিরাট একটা জ্বলন্ত সমস্যা হলো দিন গুজরানের। এই কারণেই ছোটো বয়স থেকেই ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া ছেড়ে বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।যেমন ছোটো ছোট মেয়েরা পরের বাড়ি ঠিকে কাজে, ইঁট ভাটায়,রাস্তা মেরামতের কাজে কিংবা বাবা মায়ের সাথে তাদের ছোটোখাটো ব্যবসায় সাহায্য করতে থাকে।ছোটছোট ছেলেরাও লেদের কারখানায়, দোকানে, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে,কিংবা বিভিন্ন হাতের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে একটু রোজগারের আশায়। অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের কাজেরও অভাব হয়না এই নির্দয় সমাজে।ফলে শিশু বয়স থেকেই তাদের শৈশব বলে কিছুই থাকেনা। তারা না পায় শৈশবে ভালোবাসা,আবদার স্নেহ,বা চারিত্রিক বিকাশের ফুসরত। ফলে কখনও কখনও তাদের মনে অপরাধ প্রবণতা অজান্তেই বাসা বাঁধে। খেলার ছলেই চৌর্য বৃত্তি বা বিভিন্ন নেশার যেমন ধূমপান,ডেনড্রাইট, চরস প্রভৃতি নেশার বশবর্তী হয়ে পড়ে ওরা।
এর সাথে যুক্ত করা যায় সমাজে মেয়েদের প্রতি একটা অসাম্য দৃষ্টিভঙ্গি। মেয়ে মানেই পড়াশোনার দরকার নেই।অল্প বয়স থেকেই ঘরের কাজ,একটু বড়ো হলেই বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা।আঠারো বছরের আগেই মা হওয়া এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া।গ্রামে গঞ্জে এই প্রথা চালু আছে অনেক ভাবেই।এর ফলে এই সমস্ত মেয়েদের শৈশব বলে কিছুই থাকেনা।যদিও প্রশাসনের উদ্যোগে বাল্য বিবাহ কিছুটা হলেও রোধ করা গেছে বর্তমানে।
এর সাথে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে আর একটি বিষয় যা শিশুদের শৈশবকে এক্কেবারেই শেষ করে দিচ্ছে। তা হচ্ছে, শিশুদের মানুষ করার নামে তাদের প্রতি বাবা মায়ের অকল্পনীয় প্রত্যাশা।ছোট্ট শিশুর কাঁধে বিরাট ওজনের ব্যাগের বোঝা।তার সাথে স্কুলগুলোতেও পড়াশোনার অত্যধিক চাপ প্রদান বাচ্চাদের উপর। একে তো নিউক্লিয়ার পরিবার এখন,দাদু ঠাকুমার আদর থেকে এমনিতেই বঞ্চিত এখনকার শৈশব।এর সাথে কোনো সুযোগই নেই খেলার। বন্ধু নেই, খোলা মাঠ নেই, দুষ্টুমি নেই, আবদার নেই আছে শুধুই কেরিয়ার সর্বস্ব শৈশব। তাদের ছোট্ট জীবন বাবা মায়ের আর শিক্ষক শিক্ষিকাদের স্বপ্ন পূরণের যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। গিনিপিক হয়ে খুড়োর কলের পিছনে ছোটার কৌশল শিশু বয়স থেকেই তারা রপ্ত করে ফেলেছে। ফলে তারা শৈশবের মধুর দিনগুলো কেমন হয় তার কোনো সম্যক ধরণাই মনে তৈরি হয়না। তারা অপরের দুঃখে অথবা সুখে আন্দোলিত হতে শেখেনা,বন্ধু বান্ধবের সাথে শুধুই প্রতিহিংসা আর কম্পিটিশন এর সম্পর্ক গড়ে উঠে, কীভাবে নিজেকে আরও
‘ টপার ‘ করে গড়ে তোলা যায় সেদিকেই তাদের লক্ষ্য থাকে দৃঢ়। ফলে শৈশবটা কখন অস্তমিত সূর্যের মতো ঢলে পড়ে জীবন পথে।
শিশুরা বড়ো হয়,মানুষ হয়,জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিকই শুধু তাদের বড়ো হবার পর শৈশব সম্পর্কে কোনো মনখারাপ থাকেনা,থাকেনা ক্লান্ত জীবনে একদণ্ড ফুরসৎ পেলেও শৈশবে ফিরে যাওয়ার গভীর আকুতি।